Sunday, December 03, 2006

সিঙ্গুর ইসুতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভুমিকা

পশ্চিমবঙ্গে কিছুদিন ধরেই সিঙ্গুর নিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে উঠেছে । মমতা, বুদ্ধবাবু এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছেন মেধা পাটেকর । সিপিআই এম এল (নকশাল) এবং এসইউসিআই এর মতো ছোট দলেরাও এর মধ্যে নাক গলিয়ে ফেলেছে । ফলে অবস্থা এখন বেশ সরগরম ।

কিন্তু এই ঝামেলা পাকিয়ে ওঠার জন্য দায়ী কে ? অবশ্যই আমাদের রাজ্য সরকারের দূরদৃষ্টিহীনতাই এর জন্য দায়ী । সবাই জানে যে কৃষকদের কাছে তাদের জমি হচ্ছে মহামূল্যবান । বংশ পরম্পরায় জমিই তাদের খাবার জুগিয়েছে । ভালো হোক খারাপ হোক জমিকে নির্ভর করেই তারা বেঁচে আছে । এরপর সিঙ্গুর হচ্ছে হুগলী জেলায় । সবাই জানে যে এই জেলা খুবই উর্বর । হুগলী জেলা বিখ্যাত হচ্ছে আলু চাষের জন্য । আর এখানকার চাষীদের অবস্থা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা মেদিনীপুরের চাষীদের থেকে অনেক ভালো ।

রাজ্য সরকারের বক্তব্য হচ্ছে যে টাটাদের কারখানা হলে গ্রামের মানুষেরা সেখানে চাকরি পাবেন । কিন্তু এর পরেও প্রচুর প্রশ্ন থেকে যায় । যেমন গ্রামের মানুষদের কত টাকা মাইনের চাকরি দেওয়া হবে ? তাদের চাকরিতে নিলেও কিছুদিন বাদে যে তাড়িয়ে দেওয়া হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায় ? আর যে সমস্ত চাষীরা এতদিন স্বাধীন ভাবে নিজেদের জমি চাষ করে এসেছেন তাঁরা কি অন্যের অধীনে চাকরি আদৌ করতে পারবেন ? আর বেশিরভাগ মধ্যবয়েসী কৃষকরা এতদিন চাষ করে এসেছেন এবং চাষের কাজে পটু তাঁরা কি কারখানার কাজে পটুত্ব অর্জন করতে পারবেন ?

এরপর সেখানে যদি সরকারী উদ্যোগে কিছু করা হত তাহলেও জমি ছেড়ে দেবার পক্ষে একটা যুক্তি থাকত । কিন্তু মনে রাখতে হবে সেখানে একটি বেসরকারী কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে । আর সেখানে টাটারা যে কেবল নিজেদের লাভই দেখবে তাতো জানা কথা ।

আরও প্রশ্ন হল টাটারা যদি পশ্চিমবঙ্গে কারখানা খুলতে চায় তাহলে তো তারা জমির মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি জমি কিনলেও পারত । এখানে রাজ্য সরকারের ভূমিকাটা কোথায় সেটা স্পষ্ট নয় । এখানে এটা স্পষ্ট যে রাজ্য সরকার জমির দালালি করছে । জমি পিছু চাষীদের যে টাকা দেওয়া হচ্ছে আর রাজ্য সরকার টাটাদের কাছ থেকে যে টাকা নিচ্ছে তার মধ্যে বিরাট ফারাক আছে । এই ফারাক থাকা উচিত নয় । পুরো টাকাটাই চাষীদের প্রাপ্য ।

অতএব অনেক কিছুতেই বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন আছে । সিঙ্গুর ইসুর গুরুত্ব খুবই বেশী । কারণ এর উপরেই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের রূপরেখা কি হবে । এবং অন্যান্য জায়গায় জমি অধিগ্রহন ও শিল্পায়ন কিভাবে হবে । টাটারা যখন একশো বছরেরও বেশী আগে জামশেদপুরে কারখানা খুলেছিল তখন সেই জায়গাটা ছিল একেবারই অনুন্নত । সিঙ্গুরের কারখানা খোলার আগেও টাটারা সেই নীতি গ্রহন করতে পারত । হুগলী জেলার মত উর্বর জায়গায় তারা কারখানা না খুলে পশ্চিমবঙ্গের অনুন্নত জায়গায় যথা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর বা উত্তরবঙ্গে কারখানা খুললে সেখান কার মানুষেরা দু হাত বাড়িয়ে তাঁদের স্বাগত জানাত ।

সিঙ্গুর নিয়ে সিপিএম যদি ঠিক নীতিতে না আসে তাহলে পশ্চিমবঙ্গে তাদের সবথেকে বড় শক্তি কৃষিজীবি গ্রামের মানুষেরাই তাঁদের বিপক্ষে চলে যাবেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । তারপর পুলিশ লেলিয়ে সাধারন মানুষের উপর দমন নিপীড়ন যা তারা বহু বছর ধরে চালিয়ে আসছে তা সাধারন মানুষ কিছুতেই সহ্য করে নেবে না ।

4 comments:

Arijit said...

টাটাদের কাছ থেকে পাওয়া টাকা আর চাষীদের দেওয়া টাকার মধ্যে ফারাক আছে সেটা মনে হয় ঠিক নয়। রাজ্য সরকার খুব কম দামে জমি বিক্রি করেছে, সেটাই সমস্যা। যতদূর জানি প্রায় ১৬০০০ টাকা কাঠা পিছু দেওয়া হচ্ছে যেটা বাজারদরের চেয়ে কম। সরকার মাঝখানে রয়েছে বলে জমির দালালেরা আসতে পারেনি - এটা যেমন ঠিক কথা, তেমনি সরকার বাজারদরের চেয়ে কমে জমি বিক্রি করছে সেটাও ঠিক। আরো কথা হল পুরোটাই হচ্ছে সেই উনবিংশ শতাব্দীর জমি আইন মেনে!!! জমির মালিকানা তো চাষীদের নয়। আর সরকারের তরফে আর একটা ভুল হল শুরু থেকেই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আর পুলিশ এর মধ্যে এসে গেছে, রাজনৈতিক সল্যুশন ছিলো না। হলদিয়া, বা কাটোয়াতেও কিন্তু জমি অধিগ্রহণ হয়েছে/হচ্ছে - কোন গোলমাল হয়নি। দ্বিতীয় ভুল হল বাড়াবাড়ি রকম টাটা-পন্থী হওয়া।

বিরোধীদের কথা ছেড়েই দিলাম। শুরু থেকে তাঁদের কাছে ইস্যুটা বড় নয়, কার আন্দোলন সেটাই বড় ইস্যু।

Aparna Ray said...

অরিজীত, আমার মনে হয় টাটা-পন্থী হবার কারণ বুদ্ধবাবু সিটুর ব্রিগেড সমাবেশে ভালোই খোলশা করেছেন। অবশেষে সিপিএম বুঝেছে যে শিল্পায়ন না করলে রাজ্যর কোনদিনই উন্নতি হবে না। আমার মনে হয়, শিল্পপতিরা আমাদের রাজ্যের নাম শুনলেই আতকে ওঠেন, আমাদের নানান ইউনিয়ানদের ভয়ে কেউ নিশ্চয় এখানকার ছায়াও মারাতে চান না। বুদ্ধবাবু অবশ্য বলছিলেন যে অন্যান্য রাজ্যগুলোতে শিল্প টানার এক তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে - কম দামে জমি, কম ট্যাক্স, নানান সুযোগ সুবিধা দিয়ে কিছু রাজ্য এই প্রতিযগিতায় এগিয়ে আছে, যেমন চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, ইত্যাদি। তাই বুদ্ধবাবুরাও কম্পেটিটিভ প্রাইসে টাটাদের টেনে এনেছেন। মনে করা হচ্ছে যে টাটাদের মতন হেরিটেজ কোম্পানি যদি এখানে নতুন উদ্যোগ শুরু করে তবে আরো শিল্পপতিরা এগিয়ে আসবেন। বুদ্ধবাবু তো বলেই দিলেন, যদি এই প্রকল্প না হয় তবে দেশ বিদেশে এই সিগ্‌নাল যাবে যে বাবা টাটার মতন কোম্পানি পারল না? দরকার নেই ওখানে গিয়ে অন্য কথাও যাই এবং সেটা হবে খুবই ভুল সিগ্‌নাল।

তাই টাটার সাথে পুড়ো ডিলটাই একটা ডেস পারেট আটেম্পট যেনতেন প্রকারেণ তাদের টেনে আনা এখানে। এখন তাই, ঠিক জমি দেওয়া হয়েছে কি ভুল, তা নিয়ে আর সরকার আলোচনার পথে যেতে রাজি নয়। শুধু আলোচনা হতে পারে প্যাকেজ নিয়ে।

আর জমির মালিক কে? কেন তারা চাইবে নে জমি বিক্রি করতে? আমরা দেখেছি মালিকেরা কি পরিমানে হয়রান এই বর্গাদার সিস্টেম নিয়ে। অথচ কিছুই করার উপায় নেই। আমার বাড়িতে যদি একটা ভাড়াটে থাকে বিনা ভাড়ায় যাকে আমি উঠাতে পারছি না, সেই সময়ে যদি কেউ বাড়িটা কিনতে চায়, আমি কি বাড়ি বিক্রি করে দেব না দেব না? তখন প্রতিবাদ করবে কে? নতুন মালিক যদি বাড়িটা ভেঙ্গে ফেলে তাহলে ভাড়াটেগুলি যাবে কোথায়?

আর সেই পুরানো টাটার আমল আর নেই, যে তারা কোনো ধ্যাদ্ধ্যারে গোবিন্দপুরে গিয়ে সেটাকে উপযুক্ত করে তারপর সেখানে শিল্পায়ন করবে। এখন তারা দেখছে কোথায় ফ্যাক্টরি করলে সমস্ত ইনফ্রাস্ট্রাকচার রেডিমেড পাওয়া যাবে। সেই দিক থেকে সিঙ্গুর আইডিয়াল।

দেখা যাক এই পুরো ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত।

I said...

সিপিএম মনে হচ্ছে যেন পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির জন্য উঠে পড়ে লেগেছে । গত তিরিশ বছর তারা কি করছিল । যে এখন একেবারে জর্জ বুশের ছোটভাই হয়ে উঠতে হবে ।
আমার মনে হয়ে কিছুদিন ভাবেই দেখা যাবে সিঙ্গুরে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা আরম্ভ হয়েছে । এবং এর পিছনে কাটমানির খেলাও আছে ।
যাদের জমি আছে কিন্তু অন্য লোকে চাষ করে তারা তো জমি বেচে দিতে চাইবেই । তারা তো শহরে চাকরি বাকরি করে তারা যে দাম পাবে তা নিয়ে কেটে পড়বে । কিন্তু সেই জমিতে যারা চাষ করত তাদের অবস্থা কি হবে । চাষ করে যে জমি তার এই স্লোগান কিন্তু বামফ্রন্টেরই । চাষের জমিতে শিল্প গড়ার ফল মোটেও ভাল হবে না ।

Arijit said...

কিন্তু জমিই বা কোথায়? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে যদি একটা ল্যাণ্ডম্যাপ থাকতো (বাইরের অনেক দেশের মতন), পুরো ব্যাপারটা স্বচ্ছ হত। হাজার একর জমি, এক জায়গাতে পেতে গেলে চাষের জমিতে হাত পড়বেই। সিঙ্গুর টাটাদের পছন্দ কারণ দূর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন ডাবল রেল লাইন, কলকাতার তিরিশ মাইলের মধ্যে...

সেইনসবুরি (একটা সুপারমার্কেট) নিয়ে একটা ঘটনা বলি - স্টকপোর্টে সেইনসবুরি একটা স্টোর খুললো, তারা জমি পেলো একটা শর্তে - যে সেইনসবুরির স্টোরের পিছন দিক থেকে এম৬ অবধি কানেক্টিং রাস্তা ওরাই বানিয়ে দেবে। বেশি দূর না, কিন্তু ওই কানেকশন না থাকার দরুণ স্টকপোর্টের বাসিন্দাদের লম্বা জ্যাম ঠেলে মাইল দশেক দূরে গিয়ে এম৬ ধরতে হত। সেইনসবুরি শর্ত মেনেছিলো, কারণ ওরা এটা বুঝেছিলো যে ওই রাস্তা হলে ওদেরও সুবিধা - (১) অনেক বেশি খদ্দের সহজে আসতে পারবে, (২) ওদের ডেলিভারির ট্রাকও অনেক সহজে আসতে পারবে।

আমাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো কি এভাবে ভাবে?