Monday, July 09, 2007

প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ

কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম কলকাতার কলেজ স্ট্রীটে বই কিনব বলে । সেখানে রাস্তার ধারে যারা পুরনো বই বেচে তাদেরই একজনেরই কাছে পেয়ে গেলাম পোকায় কাটা পুরোনো বই খানা ।
বইটির নাম প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ । লেখক প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় । পাঁচশো পাতার বই । দাম জিজ্ঞাসা করতে দাম হাঁকলো আশি টাকা । আমি বললাম চল্লিশ টাকা । তাতে সে দিতে রাজি হচ্ছিল না । কিন্তু আমাকে চলে যেতে দেখে অবশেষে রাজি হল চল্লিশ টাকায় দিতে । অতএব কিনে ফেললাম বই খানা ।
প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম । জানি না এখন অন্য কেউ তাঁর লেখা বই পড়েন কিনা । খুব বেশি বই তিনি লেখেননি । আমার ধারনা মেরেকেটে দশ এগারোটির মত বই তিনি লিখেছেন । বেশিরভাগই স্মৃতিচারণ, ভ্রমনকাহিনী আর ধর্ম সম্পর্কীয় লেখা ।
প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ আমার পড়া প্রমোদকুমারের তৃতীয় বই । প্রথম যে বইটি পড়েছিলাম সেটি হল হিমালয়পাড়ে কৈলাস এবং মানসসরোবর । ১৯১৮ সাল নাগাদ তিনি কৈলাস ও মানসসরোবর ভ্রমণে গিয়েছিলেন তারই বর্ণনা । প্রথম বইটি পড়েই আমার তাঁর লেখা ভাল লেগে যায় । বেশ সরল সাধাসিধে ভাষায় লেখা ভ্রমণকাহিনী ।
তাঁর লেখা দ্বিতীয় বইটি যেটা আমি পড়ি সেটা হল তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ । এই বইটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলির মধ্যে অন্যতম । লেখক একসময় ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতেন নানা জায়গায় এবং সাধু এবং তান্ত্রিকদের সাথে মেলামেশা করতেন । তাঁর সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখেছিলেন তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ ।
এই দুটি বই পড়বার পর আমার প্রমোদকুমারের লেখা আরও বই পড়বার ইচ্ছা হয় । কিন্তু তাঁর আর কোন বই হাতে পাই নি । তারপর হঠাৎই হাতে পেলাম প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ ।
প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ হল প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আত্মজীবনী । তবে এতে তাঁর পুরো জীবনের কথা নেই । তাঁর জন্ম ১৮৮৫ থেকে আরম্ভ করে ১৯১০-১১ মোটামুটি ছাব্বিশ বছরের জীবনকাহিনী এতে আছে ।
সেই সময়ে কলকাতার একান্নবর্তী ব্রাহ্মণ পরিবারের সামাজিক রীতিনীতি এবং তাঁদের দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিল তার একটা ধারনা এই বইটি থেকে পাওয়া যায় ।
বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় আমাদের সময় থেকে মাত্র একশো বছর আগে আমাদের সমাজজীবন কতটা অন্যরকম ছিল ।
প্রমোদকুমারের ছোটবেলা খুব একটা ভাল কাটেনি । বদরাগী বাবার হাতে মার খেতে খেতে আর তাঁর ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত । তাঁর নিজের কোন স্বাধীনতা ছিল না ।
কৈশোরে পদার্পন করার পরে পরেই তাঁর বিয়ে দেওয়া হয় । আর তাঁর সতেরো আঠারো বছর বয়সেই তিনি হয়ে যান দুই মেয়ের বাপ । যখন তাঁর বিয়ে কি সেটা ঠিকমতো বুঝে ওঠার বয়সও হয়নি । আবার যখন তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান তখন তাঁর পরিবারের কেউ তাঁকে একথাটা জানাবার প্রয়োজনটুকু বোধ করেননি ।
মার অসুখ শুনে বাড়ি ফিরে আসার পর এবং অসুস্থ মাকে দেখবার পর রাতের খাওয়া শেষ করে যখন তিনি ভাইয়ের কাছে নিজের স্ত্রীর খবর চান তখন সে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে যে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার রাতে বৌদি মারা গেছেন ।
বইটিতে সেসময়ের সভাসমিতি আর শিল্পীমহলের কথাও বড়ভাবে আছে । প্রমোদকুমার নিজেও আর্টকলেজে ভর্তি হয়েছিলেন আঁকা শিখবেন বলে । ফলে তখনকার শিল্পজগতের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্টতা পুরোভাবে ছিল । সেই সময়ের শিল্পীমহলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, এবং অন্তসারশূন্যতা তাঁর লেখায় বারে বারে উঠে এসেছে ।
বঙ্গভঙ্গের আগে বিভিন্ন সভাসমিতিতে লেখক উপস্থিত থাকতেন এবং বহু জ্ঞানীগুনী মানুষের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল । যাঁদের মধ্যে আছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু প্রভৃতি ।
প্রমোদকুমারের বাবা বদরাগী রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ওরফে রাজেন বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশ ঘোষ এবং বিখ্যাত অভিনেত্রী তিনকড়ি দাসী ওরফে নটী বিনোদিনীকে কিভাবে একটি বাগানবাড়িতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তার রোমহর্ষক বর্ণনা এই বইতে রয়েছে ।
পুরনো দিনের কথা পড়তে আমার সবসময়েই ভাল লাগে । তাই এইবইটিও আমি কয়েকদিনের মধ্যেই পড়ে ফেলেছি । বইটা পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একটা টাইমমেশিনে চেপে চলে গেছি একশো বছর আগে ।
বইটি পড়ে তখনকার রীতিনীতি সম্পর্কে যে সাধারন ধারনাগুলি পেলাম সেগুলো হল –
১. অল্পবয়েসে বিবাহ দেওয়া একটা প্রচলিত নীতি । মেয়েদের মোটামুটি তেরো চোদ্দ বছর আর ছেলেদের সতেরো থেকে একুশ বছরের মধ্যেই বিবাহ দেওয়া হত ।
২. সংসারে কোনো কন্যা সন্তান হওয়াকে মোটেও সাদরে গ্রহন করা হত না । আবার যদি সেই সন্তান প্রথম হয় । তবে কন্যা সন্তানের যে কোন আদর যত্ন হত না এমন নয় । অনেক বাড়িতেই আদুরে কন্যার দেখা মিলত । আবার এই লেখক মোটামুটি বিত্তশালী পরিবারের নাতি এবং বাবা মার প্রথম সন্তান হয়েও আদর যত্ন বিশেষ পাননি ।
৩. খুব শিক্ষিত উদার পরিবার ছাড়া মেয়েরা সাধারনত লেখাপড়া শিখত না । যদি বা শিখত তাও প্রাথমিক পাঠ অবধি ।
৪. বিবাহে পণ নেওয়া একেবারে সাধারন রীতিনীতির মধ্যে পড়ত । এ সম্পর্কে কোন অপরাধ বোধ ছিল না । অনেক সময় টাকাপয়সার জরুরি প্রয়োজন হলে ছেলের বিয়ে দেওয়া হত ।
৫. বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীরা পরস্পরকে প্রেমপত্র লিখত । এবং তাতে বঙ্কিমী ভাষায় প্রাণনাথ প্রাণবল্লভ প্রভৃতি সম্ভাষনের ছড়াছড়ি থাকত ।
একশো বছরে কলকাতা কতটা পালটে গেছে তা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয় । কলকাতা শহরের যে রাস্তাগুলোর উপর দিয়ে আমরা এখন হেঁটে বেড়াই সেই একই রাস্তার উপর দিয়ে লেখক চলে ফিরে বেড়িয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায় ।
কিন্তু কিছুই আর আগের মত নেই । ভারত এখন স্বাধীন । কলকাতা শহরের রাস্তায় এখন ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলে না । মটোরগাড়িতে ভর্তি এখন শহর । মাটির তলা দিয়ে ছুটেছে মেট্রো রেল । পরাধীন দেশের সেই আদর্শবাদীতা আর নেই, সবাই সবাইকে কিনতে এখন অভ্যস্ত । এসেছে ঝকঝকে মল, স্টার, মিনার্ভার জায়গায় এখন এসেছে মাল্টিপ্লেক্স । ইন্টারনেট আর মোবাইলে অভ্যস্ত ঝকঝকে যুবক যুবতীরা এখন ঘুরে বেড়ায় শহরে । একান্নবর্তী পরিবার এখন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয় ।
জানি যুগের সাথে সাথে সব কিছুই পাল্টায় । কিন্তু তবুও মাত্র একশো বছর আগেও আমরা এতটাই অন্যরকম ছিলাম । প্রাণকুমারের স্মৃতিচারণ পড়ে তাই খুবই আশ্চর্য হই । কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারি না সেই মুখগুলোকে যারা একসময় বাস করত এই কলকাতা শহরেই ।

1 comment:

Russell said...

আপনার অন্যান্য লেখার মত এটাও অপূর্ব লিখেছেন।