Wednesday, October 31, 2007

কলকাতার দুর্গাপুজো


বহু বছর ধরেই কলকাতার দুর্গাপুজো দেখে আসছি । এবারও দেখলাম । আমি কলকাতার বাইরের বাসিন্দা হলেও কলকাতা আমার কাছে নিজের ঘরের মতই কারণ আমার আমার মামার বাড়ি ও দিদির বাড়ি সহ আরও বহু আত্মীয়ের বাস কলকাতাতেই তাই পুজোর দিনগুলোতে এখানে ঘাঁটি গাড়তে কোন অসুবিধা হয় না ।

পুজোর দিনগুলোতে কলকাতা যেন এক অন্য চেহারা নেয় । এমনিতে কলকাতা রাতজাগা শহর নয় । রাত দশটা বাজলেই শহরের বহু এলাকা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায় । কিন্তু পুজোর দিনগুলোতে সারা রাত্রি শহর জেগে থাকে । বাস ও মেট্রোরেল চলে ।

কলকাতার পুজো গুলোকে এখন মোটামুটি চারভাগে ভাগ করা যায় । প্রথম হল পুরনো জমিদার ও বনেদী বংশের পুজোগুলি । যারা শত অসুবিধার মধ্যেও নিজেদের পুজো বজায় রাখতে পেরেছে । যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো বা লাটুবাবু ছাতুবাবুর বাড়ির পুজো ।

দ্বিতীয় হল সার্বজনীন পুজো । অর্থাৎ ক্লাব বা পাড়ার পুজো । সার্বজনীন পুজোগুলি আবার দুভাগে বিভক্ত । একদল চিরাচরিত ধরনের মন্ডপ এবং প্রতিমা তৈরি করেন যেমন বাগবাজার সার্বজনীন বা ম্যাডক্স স্কোয়ারের পুজো । এছাড়াও আরো বহু সার্বজনীন পুজোই এই গোত্রের মধ্যে পড়বে ।

দ্বিতীয় প্রকারের সার্বজনীন পুজোগুলিকে বলা যেতে পারে থিম পুজো ।যে ধরনের পুজোর এখন কলকাতায় রমরমা । থিম পুজোর বৈশিষ্ট্য হল প্রত্যেক বার মণ্ডপ এবং প্রতিমার চেহারা আলাদা আলাদা রকমের হয় । কোন একটি বিশেষ থিম বেছে নেওয়া হয় প্রতিমা এবং মণ্ডপসজ্জার জন্য । এই থিম যেকোন রকমেরই হতে পারে । যেমন এবারেই যে থিমগুলি দেখা গেছে সেগুলি হল বাংলার গ্রাম এবং নবান্ন, আফ্রিকার আদিবাসী গ্রাম, রাজস্থানের দুর্গ, দক্ষিন ভারতীয় মন্দির, পুরনো ভাঙা মন্দির, নোয়ার জলযান প্রভৃতি । অন্যান্য বছরে আরো রোমাঞ্চকর কিছু থিমের মধ্যে ছিল মঙ্গলগ্রহ, ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট প্রভৃতি ।

সার্বজনীন পুজোগুলি ছাড়া এখন কলকাতায় যে পুজোগুলি সংখ্যায় বাড়ছে সেগুলি হল ফ্ল্যাটবাড়ির পুজো ।

দিনে দিনে কলকাতার পুজোর বাজেট আরোও বাড়ছে এবং ছোটখাটো অল্প বাজেটের পুজোগুলিও আস্তে আস্তে বড় বাজেটের হয়ে উঠছে । কলকাতার বেশিরভাগ বড় বড় পুজোই আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে হয় না । তার বদলে এখন বড় কম্পানিগুলি বেশির ভাগ টাকা স্পনসর করে । কলকাতায় বিজ্ঞাপন করার সের সময় হল পুজোর সময় আর কম্পানিগুলি সেটা ভালোই বোঝে । যেমন এবার খুব বড়ভাবে হাজির ছিল ভোডাফোন কম্পানি। এই কম্পানিটি কলকাতায় এসেছে মোবাইল কম্পানি হাচকে কিনে নেবার মাধ্যমে । তাই পুজোর সময়কে তারা বেছে নিয়েছিল কলকাতায় নিজেদের ব্রান্ড আর লোগো কে সাধারন মানুষের কাছে পরিচয় করানোর জন্য । এইজন্য বেশির ভাগ পুজোমন্ডপে তাদের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে ।

বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং প্রভাবশালী নেতাও তাদের শক্তি পরীক্ষা করে নেয় বড় বাজেটের পুজো করানোর মাধ্যমে । অনেক সময় তাদের নাম পুজো কমিটির কোথাও থাকে না কিন্তু সবাই জানে যে এটা অমুকদার পুজো ।

কলকাতা এই কয়েকটা দিন বলা যেতে পারে যে একটি বিশাল শিল্প প্রদর্শনীতে পরিণত হয় । সাধারনলোকে খুব কমই কলকাতায় শিল্পপ্রদর্শনী দেখতে যায় বিভিন্ন গ্যালারিতে কিন্তু পুজোর সময়ে খুব সহজেই শিল্পীরা সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেন । এছাড়া বিভিন্ন থিমের পুজোর মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করা যায় । যাদের পক্ষে রাজস্থানে বা দক্ষিন ভারতে গিয়ে বিখ্যাত স্থাপত্যগুলি দেখে আসা সম্ভব নয় তারাও অন্তত কিছুটা ধারনা পেতে পারে সেই আদলে তৈরি মন্ডপগুলি দেখে ।এছাড়া বহু অজানা শিল্প ও সংস্কৃতির সাথেও পরিচয় করা যায় এই সময়ে ।

কলকাতার পুজোর আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আলোকসজ্জা । মূলত চন্দননগরের আলোকশিল্পীরাই মূলত আলোকসজ্জাগুলি তৈরি করে থাকেন । সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসে আলোকসজ্জার মাধ্যমে ।

পুজো তো চলে গেল আর অনেকের পক্ষেই কলকাতায় এসে পুজো দেখা সম্ভব নয় । তবে এবছর ডিজিট্যাল ক্যামেরার দাম কমায় আর ইন্টারনেটের প্রসার আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রচুর ছবি ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়েছে । তাই পিকাসা বা ফ্লিকারে গিয়ে Durga Puja 2007 লিখে সার্চ করলেই আপনি কলকাতার পুজোর অনেক ভালো ভালো ছবি দেখতে পাবেন ।

Saturday, October 06, 2007

শারদীয়া আনন্দমেলা, কাকাবাবুর চোখে জল এবং অন্যান্য

মনে আছে ছোটবেলায় শারদীয়া আনন্দমেলায় পড়তাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সমরেশ মজুমদারের অর্জুন আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রোমাঞ্চকর সব উপন্যাস এছাড়া শৈলেন ঘোষের রূপকথার উপন্যাসও আমার বেশ ভাল লাগত ।

তাই সেই পুরোনো স্বাদ আবার ফিরে পেতে এবারে কিনলাম শারদীয়া আনন্দমেলা । কিন্তু হতাশ হলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর উপন্যাস ‘কাকাবাবুর চোখে জল’ পড়ে । এটি একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস । সেই বস্তাপচা কিডন্যাপিং এর গল্প । কাকাবাবুর বেশির ভাগ উপন্যাসই কিডন্যাপিং সংক্রান্ত । কোন গল্পে কাকাবাবু কিডন্যাপ হয় । কোন গল্পে কিডন্যাপ হয় সন্তু বা জোজো আবার কোন গল্পে অন্য কেউ । ‘কাকাবাবুর চোখে জল’ উপন্যাসে কিডন্যাপ হল কাকাবাবুর পাড়ার একটি বাচ্চা ছেলে । তারপর কাকাবাবু কিভাবে সেই ছেলেটিকে উদ্ধার করে আনলেন সেই নিয়েই হল গল্প ।

উপন্যাসটিতে কোন প্লটের বালাই নেই । কাকাবাবু গেলেন আর কয়েকজনকে ঠেঙিয়ে ছেলেটিকে নিয়ে এলেন এই হচ্ছে গল্প । আর সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই উপন্যাসে সন্তু বা জোজোর সেরকম কোনো ভূমিকা নেই । কেবল মুখ দেখানোর জন্যই তার উপন্যাসে হাজির এরকম ব্যাপার আমি প্রথমবার দেখলাম ।

উপন্যাসটি পড়তে গেলে মনে হয় কেবল মাত্র লেখার জন্যই যেন লেখা হয়েছে । স্রেফ কিছু পাতা ভর্তি করে দেওয়া । লেখক হিসাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে কিরকম অবনতি হয়েছে এই উপন্যাসটিই তার প্রমাণ । কিছুদিন আগেই কিনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র প্রথম খন্ড । এই খন্ডেই ছিল সুনীলের কিছু বিখ্যাত উপন্যাস । যেমন আত্মপ্রকাশ, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভৃতি । কি সহজ সরল দৃপ্ত ভাষায় লেখা উপন্যাসগুলি । মানুষের বিভিন্ন অভিব্যক্তি হাসি দুঃখ রাগ কামনা কিভাবে তিনি অক্লেশে লিখেছিলেন । চকচকে ছোরার ফলার মত ছিল এক একটি উপন্যাস তাঁর । আর আজ সেই লেখকের এরকম বাজে লেখা পড়তে আমার একটুও ভাল লাগল না । অবশ্য কাকাবাবুর উপন্যাসগুলির সাথে এগুলির তুলনা চলে না । তবুও কাকাবাবুর কিছু পুরোনো উপন্যাস নতুনগুলির থেকে অনেকাংশে ভাল ছিল । যেমন বিজয়নগরের হীরে, সবুজ দ্বীপের রাজা, মিশর রহস্য, কাকাবাবু ও বজ্রলামা, নীলমূর্তি রহস্য প্রভৃতি । আর এই বিষয়ের উপর কাকাবাবুর আরেকটি উপন্যাস আছে । সেটি হল কাকাবাবু ও শিশুচোরের দল ।

শারদীয়া আনন্দমেলার আরেকটি উপন্যাস পড়লাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপার’ । কাকাবাবুর চোখে জলের মত এত বাজে না লাগলেও শীর্ষেন্দুর উপন্যাসটি পড়েও ঠিক মন ভরল না । এরকম উপন্যাস শীর্ষেন্দু অনেক লিখেছেন । মনে আছে স্কুলে পড়ার সময় যখন শীর্ষেন্দুর ঝিলের ধারে বাড়ি, গৌড়ের কবচ বা পটাশগড়ের জঙ্গলের মত উপন্যাস পড়েছিলাম তখন কি ভালোই না লেগেছিল । সেরকম ভালো লাগা অঘোরগঞ্জের ঘোরালো ব্যাপারে পাওয়া গেল না ।

মনে হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত লেখকেরা তাঁদের প্রতিভার শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন । লেখার মধ্যে সেই উদ্যম বা নতুনত্ব আর নেই । দেখা যাক নতুন লেখকেরা কেউ হাল ধরেন কিনা ।