হঠাৎই নেটে পেয়ে গেলাম এই প্রবন্ধটি পড়ে বেশ ভালো লাগল । তাই পুরোটাই তুলে দিলাম ।
কেন সফটওয়ারের মালিক থাকা উচিত্ নয়
রিচার্ড স্টলম্যান
ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি আজ আমাদের সহজে তথ্য কপি ও পরিবর্তন করার সুযোগ দিচ্ছে। কম্পিউটার একে আরো সহজতর করেছে।
তবে সবাই এই প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করতে চায় না। কপিরাইট প্রথাটি সফটওয়ার প্রোগ্রামকে একটি মালিকানাধীন বস্তুতে পরিণত করেছে। আমাদের ব্যবহৃত সফটওয়ারগুলো কপি ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা অধিকাংশ সফটওয়ার নির্মাতা শুধুমাত্র নিজেদের জন্য সংরক্ষিত রেখে সফটওয়ারগুলোর অসংখ্য সুবিধা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করতে চায়।
কপিরাইট ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছিল মুদ্রণ ব্যবস্থার সাথে। মুদ্রণ প্রযুক্তিতে যন্ত্রের সাহায্যে বিপুল পরিমাণ তথ্য ছাপানো সম্ভব হচ্ছে। কপিরাইট ব্যবস্থাটি এখানে যুক্তিসঙ্গত। কারণ এটি শুধু [প্রকাশক ব্যতীত] অপর কোন প্রকাশনা সংস্থাকে নির্দিষ্ট কোন তথ্য ছাপানো থেকে বিরত রাখে। কিন্তু কোনভাবেই এটি পাঠকের স্বাধীনতা হরণ করে না। এ জন্য সাধারণ পাঠক যার মুদ্রণযন্ত্র নেই, সে শুধু কাগজ-কলম দিয়েই প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে; আর এ ধরনের কাজের জন্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয় নি বললেই চলে।
ডিজিটাল প্রযুক্তি মুদ্রণ ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক। যখন কোন তথ্য ডিজিটাল আকারে থাকে তখন আপনি সহজেই তা কপি করে অন্যের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ডিজিটাল তথ্যের এই বৈশিষ্ট্যটি কিন্তু কোনভাবেই প্রচলিত কপিরাইট ব্যবস্থার সাথে খাপ খায় না। সেজন্যই অযৌক্তিক সফটওয়ার কপিরাইট কার্যকর করতে গিয়ে ক্রমবর্ধমান হারে বিভিন্ন নোংরা ও নির্মম পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
সফটওয়ার পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন (SPA) কর্তৃক গৃহীত চারটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করুন -
আপনার বন্ধুকে সাহায্য করতে সফটওয়ার নির্মাতা কর্তৃক নির্ধারিত শর্তাদি অমান্য করা একটি খারাপ কাজ - এই বলে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।
আপনার সহকর্মীদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে বলা।
পুলিশী সাহায্য নিয়ে অফিস ও স্কুলগুলোতে তল্লাশি চালানো। সেখানে মানুষকে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তারা নির্দোষ ও অবৈধভাবে সফটওয়ার কপি করার কাজে লিপ্ত নয়।
SPA-এর অনুরোধে মার্কিন সরকারের নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা [যেমন - এমআইটি'র ডেভিড লাম্যাকছিয়া (LaMacchia)]। সফটওয়ার কপি করার জন্য নয় বরং কপি করার যন্ত্রপাতি অরক্ষিত অবস্থায় রাখা ও তার ব্যবহার সংযত না করার ফলেই এই মামলা করা হয় [তাঁর বিরুদ্ধে কোন সফটওয়ার কপি করার অভিযোগ নেই]।
পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে উপরোক্ত এই চারটি পন্থাই প্রয়োগ করা হত। নিষিদ্ধ তথ্যের প্রতিলিপি তৈরি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সেখানে প্রতিটি কপি করার যন্ত্রের সামনে একজন পাহারাদার থাকতো। এ কারণে তথ্য কপি করার কাজটি প্রত্যেককে করতে হত গোপনে এবং তারপর তা হাতে হাতে ছড়িয়ে দেওয়া হত একটি গোপন মুদ্রণ ও বিতরণ ব্যবস্থার (Samizdat) সাহায্যে। তবে এ দুটি ঘটনার মধ্যে অবশ্যই একটি পরিষ্কার পার্থক্য আছে: সোভিয়েত ইউনিয়নে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি করার উদ্দেশ্য হল আর্থিক লাভ। তবে উদ্দেশ্যের ভিন্নতা নয় বরং উদ্দেশ্য সাধনে গৃহীত পদক্ষেপগুলোই কিন্তু আমাদের জীবনকে আক্রান্ত করে।
আমরা কিভাবে তথ্য ব্যবহার করবো তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সফটওয়ার নির্মাতাদের হাতে প্রদানের পক্ষে তারা নিম্নলিখিত যুক্তিগুলো দিয়ে থাকেন:
বিভিন্ন নামে ডাকা
নির্মাতারা কিছু নোংরা শব্দ ব্যবহার করে, যেমন - ‘বেআইনি প্রকাশনা’ (Piracy) বা ‘চৌর্যবৃত্তি’; সাথে সাথে বিশেষজ্ঞদের ব্যবহৃত কিছু টার্মও তারা ব্যবহার করে, যেমন- ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি’ ও ‘আর্থিক ক্ষতি’। মানুষের চিন্তাভাবনাকে এভাবে একটিমাত্র পথে চালানোর চেষ্টা করা হয় এবং জাগতিক বস্তু ও প্রোগ্রামের মধ্যে একটি সরল সাদৃশ্য খোঁজা হয়।
জাগতিক বস্তু সম্পর্কে আমাদের ধারণা হল যে, কারও কাছ থেকে অনুমতি ব্যতীত তার কোন জিনিষ নেওয়া বেআইনি। কোন কিছু কপি করা আর না বলে নেওয়া এক জিনিস নয়। কিন্তু নির্মাতারা এভাবেই ব্যাপারটিকে সংজ্ঞায়িত করে।
অতিরঞ্জন
নির্মাতারা বলে যে, ব্যবহারকারীরা তাদের সফটওয়ার না কিনে নিজেরাই কপি করলে তারা ‘ক্ষতি’ বা ‘আর্থিক লোকসান’ এর সম্মুখীন হয়। কিন্তু কপি করা কোনভাবেই নির্মাতাকে প্রভাবিত করতে পারে না বা এটি কারো ক্ষতিও করে না। যদি এমন হয় যে, যারা কপি করছে তাদের প্রত্যেকেই সফটওয়ারটির একেকজন সম্ভাব্য ক্রেতা, শুধুমাত্র সেক্ষেত্রেই নির্মাতা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
একটু চিন্তা করলেই কিন্তু দেখা যাবে যে, প্রতিটি লোকই আসলে একটি সফটওয়ার কিনবে না। কিন্তু নির্মাতারা এমনভাবে তাদের 'লোকসান' হিসাব করে যেন, প্রতিটি ব্যক্তিই তাদের সফটওয়ারের একটি করে কপি কিনত। এটি শুধুই বাড়িয়ে বলা হয়।
আইনের দোহাই
নির্মাতারা প্রায়ই বর্তমান আইনের কথা বলেন এবং আমাদের কঠোর জরিমানার কথা বলে ভয় দেখান। বর্তমানের আইন নৈতিকতার ব্যাপারে প্রশ্নাতীত এরকম ধারণাও তারা দিয়ে থাকেন -- একই সাথে আমাদের একথাও বিশ্বাস করতে বলা হয় যে, এ ধরনের জরিমানা প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র এবং এরকম একটি প্রথা আরোপ করার জন্য কাউকে দোষারোপ করা যাবে না।
এই জাতীয় যুক্তিগুলোকে কোন সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা বা যুক্তিধারার সম্মুখে দাঁড়ানোর মত করে তৈরি করা হয় নি। বরং এগুলো তৈরি করা হয়েছে একটি নির্দিষ্ট মানসিক চিন্তাধারাকে বলপূর্বক আমাদের চিন্তাচেতনার অংশে পরিণত করার জন্য।
এটি খুবই সাধারণ ব্যাপার যে, আইন কখনো ঠিক ও বেঠিকের মধ্যে সীমারেখা নিরূপণ করে না। প্রতিটি আমেরিকাবাসীরই জানা আছে যে, চল্লিশ বছর আগে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জন্য বাসের সামনের সিটে বসা আইনবিরুদ্ধ ছিল। শুধুমাত্র বর্ণবাদীরাই এই আইনটিকে সমর্থন করতো।
প্রাকৃতিক অধিকার
সফটওয়ার লেখকেরা প্রায়ই তাদের প্রোগ্রামের সাথে নিজেদের একটি বিশেষ সম্পর্কের দাবি করেন এবং এও দাবি করেন যে, নিজেদের লেখা সফটওয়ারের প্রতি তাদের আগ্রহ ও ভালবাসা অন্য যে কারো থেকে বেশি। (সত্যিকার অর্থে, লেখকেরা নয় বরং কোম্পানিগুলো সফটওয়ারের কপিরাইট করে - এবং আশা করে যে, যুক্তির এই সামান্য অমিলটুকু আমরা উপেক্ষা করব।)
যারা এরকম নৈতিক স্বতঃসিদ্ধ প্রচার করেন যে, প্রোগ্রাম লেখকেরা আপনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, নিজে একজন সফটওয়ার লেখক হিসেবে তাদের এসব কথার জবাবে বলবো , এটি পুরোপুরি একটি বাজে কথা।
শুধু দুটি ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত প্রাকৃতিক অধিকার সংক্রান্ত যুক্তিটি মেনে নিতে পারে।
প্রথম কারণটি হল, জড়বস্তুর সাথে সফটওয়ারের অতিরঞ্জিত তুলনা। আমি স্প্যাগেটি (নুডল্স) রান্না করার পর আমার অনুমতি ব্যতীত যদি অন্য কেউ তা খেয়ে নেয় তবে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ জানাবো; কারণ এরপর আমি আর তা খেতে পারছি না। তার কাজটি আমাকে ততটুকুই কষ্ট দেয় যতটুকু তার উপকার করে; এক্ষেত্রে কেবলমাত্র একজনই খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং প্রশ্ন হচ্ছে সে কে? আমাদের দুজনের সামান্যতম পার্থক্যটুকুই কিন্তু নৈতিকতার মানদন্ডে এ সমস্যার সমাধান করে দেয়।
আমার লেখা প্রোগ্রামটি আপনি চালান বা পরিবর্তন করুন তা আপনাকেই প্রভাবিত করে প্রতক্ষ্যভাবে এবং আমাকে পরোক্ষে। আপনি আপনার বন্ধুকে কোন সফটওয়ারের একটি কপি দিয়ে থাকেন বা না থাকেন তা আমাকে প্রভাবিত করার চেয়ে আপনাকে এবং আপনার বন্ধুকে প্রভাবিত করে বেশি। আপনার বন্ধুকে সফটওয়ারটির একটি কপি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলার কোন অধিকার আমি রাখি না। এই অধিকার কোন ব্যক্তিরই থাকার কথা নয়।
দ্বিতীয় কারণটি হল, আমাদেরকে বলা হচ্ছে যে, লেখকদের প্রাকৃতিক অধিকারের ব্যাপারটি আমাদের সমাজের একটি অনুমোদিত ও প্রশ্নাতীত ঐতিহ্য।
ঐতিহাসিকভাবে কিন্তু এর বিপরীতটিই সত্য। যখন মার্কিন সংবিধান তৈরি করা হচ্ছিল তখন কপিরাইটকে লেখকদের প্রাকৃতিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। সেজন্য মার্কিন সংবিধানে কপিরাইট প্রক্রিয়াকে অনুমোদন করা হলেও কখনোই একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়রূপে গণ্য করা হয় না; এজন্য সংবিধান অনুসারে কপিরাইটের কার্যকারীতা সাময়িক। সংবিধানে আরো বলা হয় যে, কপিরাইটের উদ্দেশ্য হবে প্রগতিকে সহায়তা করা, লেখকদের পুরস্কৃত করা নয়। কপিরাইট অবশ্যই লেখককে এবং আরো বেশি করে প্রকাশককে পুরস্কৃত করে তবে এটি শুধু তাদের আচরণ পরিবর্তনের উপায় হিসাবেই রাখা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের সমাজে কপিরাইট প্রথাকে জনগণের প্রাকৃতিক অধিকারের পরিপন্থী বলে মনে করা হয় - এ কারণে শুধুমাত্র বিশেষ জনস্বার্থেই এর প্রয়োগকে ন্যায্য প্রতিপাদন করা যায়।
অর্থনৈতিক কারণ
সফটওয়ারের মালিকানা প্রথার ব্যাপারে চূড়ান্ত যুক্তিটি হল, এটি অপেক্ষাকৃত বেশি সফটওয়ারের উত্পাদন নিশ্চিত করে।
কিছুটা হলেও, এই কারণটি মালিকানা প্রথাকে অনেকটা যুক্তিসম্মতভাবে উপস্থাপন করে। এটি একটি বৈধ উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে রচিত - উদ্দেশ্যটি হল সফটওয়ার ব্যবহারকারীদেরকে সন্তুষ্ট করা। আর এটি খুবই স্বাভাবিক যে, ভাল মজুরির ব্যবস্থা থাকলে মানুষ যেকোন কিছুই তুলনামূলকভাবে বেশি পরিমাণে উত্পাদন করে।
তবে এই অর্থনৈতিক যুক্তিটিতেও একটি সমস্যা আছে: এটি এই ধারনার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, আমাদের প্রদেয় অর্থের পরিমাণের উপর ভিত্তি করেই সফটওয়ার উত্পাদনে তারতম্য দেখা যায়। এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, আমাদের কাছে ‘সফটওয়ারের উত্পাদন’ বিষয়টিই জরুরি - সফটওয়ারের মালিক থাকলো কি থাকলো না সেটা কোন ব্যাপার নয়।
এই ধারনাটিকে জনগণ সহজেই গ্রহণ করে কারণ জড়বস্তু সম্পর্কিত আমাদের দৈনন্দিন ধারনার সাথে এটি মিলে যায়। উদাহরণস্বরূপ একটি স্যান্ডউইচের কথাই ধরুন। আপনি বিনামূল্যে অথবা অর্থের বিনিময়ে একটি স্যান্ডউইচ পেতে পারেন। যদি তাই হয় তবে দুটি উপায়ের মধ্যে একমাত্র পার্থক্যটি হল আপনার পরিশোধিত অর্থ। আপনি এটি কিনে থাকেন বা না থাকেন - স্যান্ডউইচটির সেই একই স্বাদ ও পুষ্টিমান বজায় থাকে এবং উভয় ক্ষেত্রেই আপনি এটি মাত্র একবারই খেতে পারবেন। স্যান্ডউইচটি খাওয়ার পর আপনার নিকট অবশিষ্ট অর্থ ব্যতীত আর কিছুই ইতিপূর্বে স্যান্ডউইচটির একজন মালিক ছিল কি ছিল না, তার ওপর সরাসরি নির্ভর করছে না।
যেকোন ধরনের জড়বস্তুর ক্ষেত্রেই এটি সত্য। বস্তুটি যা-ই হোক না কেন, পাওয়ার পর সেটা দিয়ে আপনি ইচ্ছামাফিক কাজকর্ম করতে পারেন এবং এজন্য আপনাকে এর পূর্বতন মালিকের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
কিন্তু যদি একটি প্রোগ্রামের মালিক থাকে তবে তা হয়ে যায় অন্যান্য বস্তু থেকে পৃথক প্রকৃতির এবং প্রোগ্রামটির একটি কপি কেনার পর তা দিয়ে আপনি যা যা করতে পারবেন তাও পূর্বনির্দিষ্ট। ফলে অন্যান্য জড়বস্তুর সাথে এর পার্থক্যটা শুধু আর পরিশোধিত অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সফটওয়ারের মালিকানা প্রথাটি মালিকদেরকে কিছু না কিছু উত্পাদনে উত্সাহিত করে - কিন্তু সেটা যে সমাজের চাহিদা মোতাবেকই হবে, এমন কিন্তু নয়। পাশাপাশি এই প্রথাটি নৈতিকতাকে দূষিত করে অকল্পনীয় মাত্রায়, শেষ পর্যন্ত যা আমাদের সকলেরই ক্ষতি করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজের কী প্রয়োজন? সমাজ সত্যিকার অর্থে এমন তথ্য চায় যা প্রতিটি নাগরিকই সহজে পেতে পারে -- উদাহরণস্বরূপ, এমন সফটওয়ার যা শুধু ব্যবহার করার মধ্যেই নাগরিকদেরকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে না বরং তারা সফটওয়ারটিকে বোঝা, ভুল সংশোধন করা, পরিবর্তন করা এবং আরো উন্নত করার কাজগুলোও করতে পারবে। কিন্তু সফটওয়ার নির্মাতাদের নিকট থেকে আমরা সাধারণত যা পাই তা যেন একটি তালাবদ্ধ বায়স্কোপের বাক্স - একে বোঝার বা পরিবর্তন করার কোন সুযোগই আমাদের নেই।
সমাজের আরো প্রয়োজন স্বাধীনতা। যখন কোন প্রোগ্রামের একজন মালিক থাকে তখন ব্যবহারকারীগণ তাদের নিজেদের জীবনের একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারায়।
আর সবচেয়ে বড় কথা হল, সমাজ জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পারস্পরিক সহযোগিতার মানসিকতাকে উত্সাহিত করতে চায়। যখন সফটওয়ারের মালিকগণ বলেন যে, স্বাভাবিক উপায়ে আমাদের প্রতিবেশীদের সাহায্য করা “বেআইনি” (Piracy) তখন তারা সমাজের নাগরিক চেতনাকেই দূষিত করেন।
একারণে ফ্রী সফটওয়ারের মূল বিষয়টি হল “ব্যবহারের স্বাধীনতা”, সফটওয়ারের মূল্য নয়।
সফটওয়ার মালিকগণ যে অর্থনৈতিক যুক্তি দেখান তা ভুল হলেও অর্থনৈতিক ব্যাপারটি সত্য। কিছু মানুষ প্রোগ্রাম লেখার আনন্দে বা এ কাজটির প্রতি তাদের ভালবাসার কারণেই ভাল ভাল প্রোগ্রাম লেখেন। কিন্তু আমরা যদি আরো সফটওয়ার চাই তবে আমাদেরকে তহবিল বাড়াতে হবে।
বিগত প্রায় দশ বছর ধরে ফ্রী সফটওয়ার ডেভেলপারগণ বিভিন্নভাবে তহবিল বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন এবং কিছুটা সাফল্যও পেয়েছেন। কাউকে ধনী বানানোর কোন প্রয়োজন নেই; মার্কিন পরিবারসমূহের গড়পড়তা বার্ষিক আয় প্রায় ৩৫০০০ ডলার এবং এই অর্থ প্রোগ্রামিং অপেক্ষা কম তৃপ্তিদায়ক কাজের জন্যও বেশ আকর্ষণীয় পারিশ্রমিক।
একটি ফেলোশীপ পাওয়ার পূর্বে অনেক বছর যাবত্ নিজের লেখা ফ্রী সফটওয়ারগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চাহিদামাফিক নানা রকম পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধন করে আমি জীবিকা নির্বাহ করতাম। এ ধরনের প্রতিটি পরিবর্ধন-ই সফটওয়ারের মূল সংস্করণের সাথে যোগ করা হত এবং পরবর্তীতে এভাবে সকলেই তা ব্যবহার করার সুযোগ পায়। গ্রাহকবৃন্দ আমাকে এর জন্য অর্থ প্রদান করত যেন আমার লেখা সফটওয়ারসমূহে তাদের ইচ্ছামাফিক বৈশিষ্ট্য যোগ করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে সংশ্লিষ্ট সফটওয়ারটিতে এ সকল বৈশিষ্ট্য যোগ করা আমার ইচ্ছাতালিকায় সর্বাগ্রে ছিল তাও আমি মনে করতাম না।
ফ্রী সফটওয়ার ফাউন্ডেশন (FSF) একটি করমুক্ত সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ফ্রী সফটওয়ারের জন্য তহবিল তৈরির লক্ষ্যে এটি বিক্রি করছে গনুহ (GNU ) সিডি-রম, টিশার্ট, ম্যানুয়াল এবং ডিলাক্স ডিস্ট্রিবিউশন (এসব কিছুই ব্যবহারকারীরা কপি বা পরিবর্তনের অধিকার রাখেন)। এটি বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুদান হতেও তহবিল সংগ্রহ করছে। এই প্রতিষ্ঠানে এখন পাঁচজন প্রোগ্রামার এবং মেইল অর্ডার সামলানোর জন্য তিনজন কর্মী আছেন।
কিছু ফ্রী সফটওয়ার ডেভেলপার বিভিন্ন ধরনের সেবার বিনিময়ে আয় করে থাকেন। যেমন - “সিগনাস সাপোর্ট” এর ৫০ জন কর্মীর মধ্যে ১৫% এর কাজ ফ্রী সফটওয়ার তৈরি করা - যেকোন সফটওয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন - ইন্টেল, মটোরোলা, টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্ট্স এবং অ্যানালগ ডিভাইসেস একত্রিত হয়ে প্রোগ্রামিং ভাষা “সি” এর ফ্রী গনুহ কম্পাইলার তৈরির জন্য অর্থ সরবরাহ করেছিল। 'অ্যাডা' প্রোগ্রামিং ভাষার ক্ষেত্রে অর্থ যোগান দিয়েছিল মার্কিন বিমান বাহিনী। মার্কিন বিমান বাহিনী বিশ্বাস করে যে, একটি উন্নতমানের কম্পাইলার পাওয়ার জন্য এটিই হবে সর্বাপেক্ষা ব্যায়সাশ্রয়ী পন্থা। [কিছুদিন পূর্বে এই প্রকল্পে বিমান বাহিনীর অর্থায়ন শেষ হয় এবং গনুহ 'অ্যাডা' কম্পাইলারটি এখন বিমানবাহিনীসহ সকলে ব্যবহার করছে। কম্পাইলারটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে।]
এগুলো খুবই ক্ষুদ্র কিছু উদাহরণ মাত্র; ফ্রী সফটওয়ার আন্দোলনটিও এখনো ক্ষুদ্র ও বয়সে নবীন। কিন্তু এদেশে [মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র] শ্রোতাগোষ্ঠির সহায়তায় পরিচালিত বেতার কেন্দ্রের উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, প্রতিটি ব্যবহারকারীকে অর্থ দিতে বাধ্য না করেও এ ধরনের বিরাট কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব।
বর্তমানে একজন কম্পিউটার ব্যবহারকারী হিসেবে আপনি হয়ত একটি মালিকানাধীন (Proprietery) প্রোগ্রাম ব্যবহার করছেন। যখন আপনার বন্ধু এটি কপি করতে চাচ্ছে তখন তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা ভুল হবে। কারণ পারস্পরিক সহযোগিতা কপিরাইট হতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এভাবে গোপনে পরস্পরকে সহযোগিতা করা কখনোই একটি ভাল সমাজ তৈরিতে সাহায্য করে না। প্রতিটি মানুষই মর্যাদা ওস্ম্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়; আর এর অর্থই হল মালিকানাধীন সফটওয়ারের প্রতি “না” বলা।
আপনার অধিকার আছে সর্বসমক্ষে স্বাধীনভাবে অন্যান্য সফটওয়ার ব্যবহারকারীদেরকে সাহায্য করার। আপনার অধিকার আছে সফটওয়ারের কর্মপদ্ধতি জানার এবং শিক্ষার্থীদের তা জানানোর। আপনার অধিকার আছে অচল সফটওয়ারটিকে সচল করার জন্য প্রিয় প্রোগ্রামারকে অর্থের বিনিময়ে নিয়োজিত করার।
আপনার অধিকার আছে সকল সফটওয়ারকেই ফ্রী সফটওয়াররূপে ব্যবহার করার।
এই রচনাটি Free Software, Free Society: The Selected Essays of Richard M. Stallman এ প্রকাশিত হয়েছে।
গনু এবং এফএসএফ (FSF) সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকলে অনুগ্রহপূর্বক <gnu@gnu.org> এই ঠিকানায় ই-মেইল করুন। এছাড়া অন্যান্য উপায়েও এফএসএফ-এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
Copyright 1994, Richard Stallman (কপিরাইট ১৯৯৪, রিচার্ড স্টলম্যান)
Verbatim copying and distribution of this entire article is permitted in any medium, provided this notice is preserved. ( এই বিজ্ঞপ্তিটি সংরক্ষণ করা সাপেক্ষে সম্পূর্ণ রচনাটি অবিকৃত অবস্থায় যেকোন মাধ্যমে কপি ও বিতরণ করার অনুমতি দেওয়া গেল। )