Sunday, March 11, 2007

চাকরি ছাড়ার ইতিবৃত্ত

কিছু কিছু অফিসে পরিস্থিতি হচ্ছে এরকম যে দলে দলে কর্মীরা আসছে আর যাচ্ছে । অর্থাৎ কর্মীদের চাকরি ছেড়ে দেবার হার প্রচুর । অনেক সময়ে মাত্র তিনমাসের ব্যবধানে দেখা যায় অফিসে সব নতুন মুখ । অফিসের চেহারাই যেন পালটে গেছে । আবার তিনমাস পরে গেলেই দেখা যায় যে আবার বহুলোক ছেড়ে দিয়েছে এবং অন্যরা যোগ দিয়েছে ।

কিন্তু বেসরকারী চাকরিতে ছেড়ে দেবার এত বেশী হার কেন । ম্যানেজমেন্ট অনেক সময়েই দোষ চাপায় কর্মীদের উপরে । তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে সামান্য কিছু টাকা বেশি পাবার লোভে কর্মীরা চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে । কিন্তু আমার মনে হয় ব্যাপারটা এত সহজ সরল নয় । বেশিরভাগ কর্মীই শুধুমাত্র কিছু টাকা বেশি পাবে বলে চাকরি বদলায় না । চাকরি বদলানোর পিছনে বেশ কিছু অন্য কারনও কাজ করে ।

আমি গত প্রায় আড়াই বছর ধরে কলকাতায় বেসরকারি চাকরি করছি । বর্তমানে আমি আমার পঞ্চম চাকরি করছি । কোনও অফিসে আমার সর্বাধিক থাকার রেকর্ড হল মাত্র নয় মাস । এরকম ব্যাপার শুধু আমার ক্ষেত্রে নয় আরও বহু জনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে । কোন অফিসে কেউ যদি দুই বছর কাটায় তাহলেই সবাই অবাক হয়ে যায় যে কি করে সে দুই বছর একই কম্পানিতে কাটিয়ে দিল । মোটামুটি ভাবে চাকরি ছাড়ার পিছনে কারনগুলো যদি খোঁজার চেষ্টা করি তাহলে সেগুলো দাঁড়াবে এরকম --

১. ইন্টারভিউয়ের সময়ে ম্যানেজমেন্ট যা বলে পরে দেখা যায় সেগুলো অনেক কিছুই মিলছে না । যেমন বলা হল আমাদের অফিস সন্ধ্যে ছটায় ছুটি । কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল যে ছুটির টাইমটা আসলে সাতটা ছাড়িয়ে আটটা সাড়ে আটটায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে । কিংবা ইন্টারভিউয়ের সময়ে বলা হয়েছিল আপনাকে এই ধরনের কাজ করতে হবে । কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তার বাইরেও আরো অনেক ধরনের কাজ দেওয়া হতে লাগল যেটা তার করার কথা ছিল না । অর্থাৎ স্পষ্টই বোঝা গেল যে ইন্টারভিউয়ের সময়ে ম্যানেজমেন্ট তথ্য গোপন করেছিল ।

২. উৎসাহের অভাব চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে একটা প্রধান কারন বলে মনে হয় । অর্থাৎ কারও কর্মকুশলতার অভাব হলে ম্যানেজমেন্ট স্টেপ নেবে কিন্তু কেউ যদি ভালো কাজ করে তবে তার জন্য কোন ধন্যবাদ বা উৎসাহ দেবে না । ভাব খানা হল এই যে মাইনে দিচ্ছি এই ঢের আবার ধন্যবাদ দিতে হবে নাকি ।

৩. কাজের পরিকল্পনার অভাব যার ফল ভুগতে হয় কর্মীদের । অর্থাৎ ম্যানেজমেন্ট কাজ ধরেই খালাস । কিন্তু সেই কাজটা কিভাবে সুষ্ঠুভাবে করা যেতে পারে সে বিষয়ে কোন চিন্তাভাবনা নেই । ফলে তিন দিনের কাজ শেষ হতে লাগছে আটদিন আর দায় গিয়ে পড়ছে কর্মীদের উপর ।

৪. ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কর্মীদের যোগাযোগের অভাব । যার ফলে কর্মীরা বুঝতে পারছে না তাদের সঠিক দায়িত্বটা কি । আর ম্যানেজমেন্ট বুঝতে পারছে না যে কর্মীদের কাজ করতে কি সমস্যা হচ্ছে ।

৫. পরিকাঠামোর অভাব । কর্মীদের কাজ করার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই অথচ তাদের বলা হচ্ছে ঠিক সময়ে সঠিক ভাবে কাজ শেষ করতে । অর্থাৎ ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার ।

৬. ম্যানেজমেন্টের জ্ঞান এবং দক্ষতার অভাব । অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে অফিসে যে ধরনের কাজ হয় সে ব্যাপারে অফিসের মালিকপক্ষ বা ম্যানেজমেন্টের কোন জ্ঞান নেই । তার শুধু টাকা ইনভেস্ট করেই খালাস । ফলে কোন কাজে কোন সমস্যা দেখা দিলে তাদের সেই সমস্যা বোঝার দক্ষতা বা ধৈর্য কোনটাই নেই । তাদের খালি টাকায় ইন্টারেস্ট ।

৭. কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই । অর্থাৎ অফিস যেমন চলছে চলুক । এর থেকে আর বেশি বাড়াব না । যেরকম কাজ করছি সেই রকম কাজই করে যাব, নতুন কোন কাজের চেষ্টা করব না । কর্মীদের যদি অন্যান্য কাজে দক্ষতাও থাকে তাহলেও সেই দক্ষতাকে কাজে লাগাব না ।

৮. খারাপ ব্যবহার । এটা করে অফিসের ম্যানেজমেন্ট নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করে । কর্মীরা সেই অবস্থায় কিছু না বললেও পরে এর শোধ ঠিকই নেয় । চাকরি ছাড়ে ঠিক মোক্ষম সময়ে । যার ফলে কোন প্রজেক্ট ডুবে যায় এবং মালিকপক্ষের সাড়ে সর্বনাশ হয় ।

৯. অবাস্তব টার্গেট বা ডেডলাইন দেওয়া । অনেক সময়েই ম্যানেজমেন্ট জেনেশুনেই কর্মীদের উপরে অবাস্তব টার্গেট বা ডেডলাইন চাপিয়ে দেয় । এবং এব্যাপারে তারা কর্মীদের সাথে কোন আলোচনাও করে না ।

১০. মাইনে বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা না থাকা । ম্যানেজমেন্ট মৌখিকভাবে কর্মীদের কাজের খুব প্রশংসা করে কিন্তু মাইনে বাড়ানোর কথা উঠলেই চুপচাপ হয়ে যায় । কর্মীদের এই শুকনো প্রশংসায় যে মন ভরবে না সেটাই তো স্বাভাবিক ।

কোন ভুলভাল অফিসে ম্যানেজমেন্টের ব্যবহার কিরকম হয় তা নিজের দেখা একটা ঘটনা বলি ।

একটা অফিসে আমি গ্রাফিক ডিজাইনার হিসাবে কাজ করতাম । সেখানে একজন প্রজেক্ট ম্যানেজারের আন্ডারে দুজন প্রোগ্রামার কাজ করত । আমরা একই ঘরে বসতাম । সেই ম্যানেজার একজন প্রোগ্রামারকে জিজ্ঞাসা করল কিরে তোর কাজ হল ? ছেলেটি বলল না এখনও হয়নি । কি এখনও হয়নি ! খেঁকিয়ে উঠল ম্যানেজার । আর কবে হবে ?

খানিকক্ষন বাদে প্রজেক্ট ম্যানেজার আবার জিজ্ঞাসা করল কিরে হল ? এবার ছেলেটি বলল হ্যাঁ হয়ে গেছে । প্রজেক্ট ম্যানেজার এবারও খেঁকিয়ে উঠল । সেকি ! হয়ে গেছে ! তবে এখনও চুপ করে বসে আছিস কেন ?

ছেলেটি কয়েকদিন বাদে থেকেই অফিসে আসা বন্ধ করল । এবং বহু চেষ্টা করেও সেই প্রজেক্ট ম্যানেজার তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারল না ।

তবে চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে সব দোষই যে ম্যানজমেন্টের এমন আমি মনে করি না । অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদেরও দায়িত্ব থাকে । শুধুমাত্র ভাল লাগছে না বলে চাকরি ছেড়ে দিতেও আমি দেখেছি ।

তবে কর্মীদের দায়িত্ব থাকে যেমন কম্পানিকে স্যাটিসফাই করা তেমনি কম্পানিরও দায়িত্ব কর্মীদের চাহিদা মেটানো । যদি কোন কর্মী মনে করে যে তার কম্পানি তাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মাইনে দিচ্ছে না তবে সে তো অন্য কোন জায়গায় জয়েন করতেই পারে । এর মধ্যে তো দোষের কিছু নেই । তবে তার নির্দিষ্ট সময়ের নোটিশ দিয়ে তবেই ছাড়া উচিত । যাতে কোন পক্ষেরই কোনো অসুবিধা না হয় ।

আমার মাত্র আড়াই বছরের অভিজ্ঞতার উপরে আমি এই লেখা লিখলাম । হয়ত সময়ের সাথে সাথে আমার দৃষ্টিভঙ্গিও কিছুটা পালটাতে পারে । আর সব সংস্থায় যে এরকম অবস্থা তা মনে করার কোন কারন নেই । অনেক অফিসেই সুন্দর ব্যবস্থা নীতি এবং পরিকল্পনা থাকে । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার কেরিয়ারের শুরুর সংস্থাগুলোতে আমাকে এই রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ।

No comments: