Thursday, October 26, 2006

রেডিও ও আমি


আমাদের ছোটবেলায় রেডিও ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম । বেশিরভাগ বাঙালি বাড়িতেই রোজ সন্ধেবেলা রেডিওতে খবর ও নাটক শোনা ছিল জরুরী বিষয় । কিন্তু তখন রেডিও ছিল আমার নাগালের বাইরে ।

যখন আমি রেডিও নিয়ে নাড়াচাড়া করি তখন আমাদের বাড়িতে টিভি ভালই জাঁকিয়ে বসেছে । কিন্তু তবুও আমি রেডিও শুনতাম । আমার বাবা-মার বিয়ের পুরনো রেডিওতে আমি বিবিধ ভারতী, যুববাণী আর বিভিন্ন শর্টওয়েভ চ্যানেল শুনতাম ।

শর্টওয়েভে বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা প্রভৃতি স্টেশন শুনে বেশ একটা আর্ন্তজাতিক অনুভূতি হত । এছাড়াও নানা অচেনা জায়গার এবং অচেনা ভাষার স্টেশন শুনে বুঝতে চেষ্টা করতাম যে সেটা কোথাকার স্টেশন । পৃথিবীর বহুদেশই বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করত নিয়মিত ভাবে । সম্ভবত এখনও করে ।

আমি মাধ্যমিক পাস করার পর নিজের মিউজিক সিস্টেম কিনি । তাতে ক্যাসেট চালিয়ে গান শোনা যেত এবং রেডিও শোনা যেত । এই সিস্টেমটা কেনার পর প্রথম আমি কলকাতার এফএম স্টেশন শুনতে পাই । কারণ এর আগের বাড়ির পুরনো রেডিওগুলোতে এফএম ছিল না ।

মিডিয়াম ওয়েভ এবং শর্টওয়েভের থেকে এফএম এর সাউন্ড কোয়ালিটি অনেক ভাল । তখন অবশ্য কলকাতায় একটিই এফএম স্টেশন ছিল । তা ছিল আকাশবাণীর । এই এফএম স্টেশনের জনপ্রিয়তা খুবই বেশী ছিল । বহু বাড়ী, দোকানে সবসময় এফএম চলত । অনেকে রেডিও না কিনে শুধুমাত্র একটা বক্স কিনে নিত আর তার সাথে একটা এফএম রিসিভার লাগিয়ে নিত । এগুলোতে এফএম ছাড়া অন্য কিছু শোনা যেত না ।

আকাশবাণীর এফএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে গানের থেকে বকবকানি বেশি হয় । বাস্তবিকই অনেক সময়ে দেখা যেত সঞ্চালক সঞ্চালিকাদের বকর বকর এবং জ্ঞান বিতরন গানের থেকে অনেক বেশী সময় ধরে হচ্ছে । এছাড়া এই স্টেশনে বেশিরভাগ সময়েই শুধু পুরনো গান শোনান হত । নতুন গান খুব কম শোনানো হত । ফলে অল্পবয়সীদের মধ্যে এই এফএমএর জনপ্রিয়তা খুব একটা বেশী হয় নি । আকাশবাণীর এই স্টেশনে ফোন করে অনেকে নানা বিষয়ে নিজের মতামত জানাতেন । প্রায়ই দেখা যেত যে একই লোক রোজই ফোনের লাইন পাচ্ছেন আর বহু লোক অভিযোগ করতেন যে তাঁরা বহুবার চেষ্টা করেও একবারও লাইন পাচ্ছেন না । এটা একটা রহস্যজনক ব্যাপার ছিল যে একই লোক কিভাবে বার বার ফোনের লাইন পায় । এই ব্যাপার কুখ্যাত ছিল মধ্যমগ্রাম এলাকা । দেখা যেত যে মধ্যমগ্রামের লোকেরা খুব সহজেই এফএমের ফোনের লাইন পায় । এর মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ভুলু সাহা এবং নান্টু সাহা । এফএমে ফোন করে করে ভুলু সাহা প্রায় বিখ্যাত লোক হয়ে পড়েছিলেন । যেকোন লোক একডাকে ভুলু সাহাকে চিনত ।

এরমধ্যে অবশ্য শর্টওয়েভ রেডিও মাঝে মাঝে শুনতাম । কারগিল যুদ্ধের সময় শর্টওয়েভ রেডিওতে পাকিস্তানের প্রোগ্রাম শুনে হাসি পেত । যেকোন উপায়ে ভারতের নিন্দে করাই যেন পাকিস্তান রেডিওর একমাত্র উদ্দেশ্য । যেমন গানের প্রোগ্রামে একটি করে গান শোনানো হত এবং সঞ্চালিকা খানিকক্ষন ভারতের পিণ্ডি চটকাতেন । তারপর আবার একটা গান । নানা ভাবে নানা উপায়ে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার জন্যই যেন স্টেশনটি খোলা হয়েছে । খুব রাগ হত যখন সঞ্চালিকা উগ্রপন্থীদের শহীদ আর ভারতের বীর জওয়ানদের দুশমন বলতেন ।

২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে যখন আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমন করে তখন যুদ্ধ লাগার প্রথম খবর আমি শর্টওয়েভ রেডিও থেকেই পেয়েছিলাম ।

এরমধ্যেই একবার খবরের কাগজে পড়লাম যে সরকার প্রাইভেট এফএম স্টেশনের লাইসেন্স মঞ্জুর করেছে । তখন থেকে আরম্ভ হল আমার প্রতীক্ষা । লাইসেন্স দেবার বহু দিন পরে প্রায় বছর দুয়েক হবে কলকাতায় একই সঙ্গে একই দিনে চারটি নতুন চব্বিশ ঘন্টার প্রাইভেট এফএম স্টেশন চালু হল । বলা যায় কলকাতায় রেডিওর পুর্নজন্ম হল ।

এই চারটি স্টেশন হল আমার এফএম, রেডিও মির্চি, রেড এফএম এবং পাওয়ার এফএম । চারটি চ্যানেলে একদম নতুন গান চব্বিশ ঘন্টা ধরে শোনান হতে লাগল । কলকাতার রাস্তায় পঞ্চাশ টাকা করে ঝুড়ি করে এফএম রেডিও বিক্রি হতে লাগল ।

এই নতুন স্টেশনগুলিও সমালোচনা থেকে মুক্ত ছিল না । বিশেষ করে আমার এফএম এবং পাওয়ার এফএম এ একই গান বহুবার শোনানো হত । গানের বৈচিত্র বড়ই কম ।

আমি প্রথম কাজ পাই কলকাতার একটা অফিসে দুই মাসের কন্ট্রাক্টে ডেটা কনভারসন করার । সেখানে কাজের একঘেয়েমি দূর করার জন্য একটা এফ এম রেডিও লাগানো ছিল । কোনো এক রহস্যজনক কারণে রেডিওটিতে পাওয়ার এফএম ছাড়া আর কোন স্টেশন ধরত না । আর আমাদের বার বার একই গান শুনে মাথা খারাপ হবার যোগাড় ।

মাত্র কয়েকদিন আগে কলকাতায় শুরু হয়েছে পঞ্চম প্রাইভেট এফএম চ্যানেল বিগ এফএম । শোনা যাচ্ছে আরও কয়েকটি এফএম চ্যানেল কলকাতায় চালু হতে চলেছে । যাতে শুধুমাত্র গান ছাড়া অন্যান্য খবর ভিত্তিক অনুষ্ঠানও শোনা যাবে ।

কলকাতায় স্যাটেলাইট রেডিওর বিক্রিও বেশ কিছুদিন ধরে শুরু হয়েছে । কিন্তু স্যাটেলাইট রেডিও সফল হওয়া খুবই মুশকিল । কারণ এই রেডিওর মাসিক চার্জ আছে । আর এফএম চ্যানেলগুলোতেই যখন ফ্রীতে এত গান শোনা যাচ্ছে আর সস্তার এমপিথ্রীতে যখন বাজার ভরে গেছে তখন আবার মাসিক চাঁদা দিয়ে গান শোনার কোন মানে হয় না ।

2 comments:

Anonymous said...

বক্কা মানে কি? বার বার তেমন লেখা দেখছি
মানেটা খুলে বলুন৤ কোলকাতায় এমন শব্দ শুনি না৤

Smritilekha C said...

বেশ ভালো লাগলো। ঠিক আমার মনের কথা-টি বললেন!