Saturday, August 19, 2006

আমাদের অতীত

বাঙালি হিসাবে আমাদের অতীত যে খুব একটা উজ্জ্বল নয় সে কথা বলাই বাহুল্য । কখনো কখনো আমি যখন আমাদের অতীতের কথা ভাবি তখন আঁতকে উঠতে হয় । আজ থেকে মাত্র দেড়শো দুশো বছরে আগেই আমরা ছিলাম কুসংস্কারে ঢাকা অন্ধকারে আচ্ছন্ন । কারোর স্বামী মারা গেলে সেই শোকসন্তপ্ত বিধবাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হত শ্মশানে স্বামীর চিতায় জ্বলে পুড়ে মরবার জন্য । যাতে তার বাস্তবজ্ঞান না থাকে সেজন্য তাকে আফিম জাতীয় মাদক খাওয়ানো হত । ঢাক ঢোল বাজিয়ে নানা রকম ভাবে শোভাযাত্রা করে সেই হতভাগ্য মহিলাকে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হত । তারপর তাকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মারা হত । অনেক সময় আধপোড়া অবস্থায় সেই মহিলা বা অনেক সময় চোদ্দ পনের বছরের কিশোরী মেয়ে যখন চিতা থেকে উঠে পালাতে চাইত তখন তাকে বাঁশ দিয়ে ঠেসে দেওয়া হত চিতার মধ্যে । অনেক সময় পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেওয়া হত যাতে সে পালাতে না পারে । তার চিৎকার ঢাকা পড়ে যেত ঢাক ঢোলের শব্দে । আর এই ঘটনা সবাই ভিড় করে দেখতে আসত ।
তাও যারা চিতায় মরত মৃত্যুতে তাদের যন্ত্রনার অবসান হত কিন্তু যারা প্রানে বেঁচে থাকত তাদের আরো অবর্ণনীয় যন্ত্রনার মধ্যে দিন কাটাতে হত । হয়তো ধনী পরিবারের কন্যা বা বধূ হলেও তাদের চুল কেটে নেওয়া হত, পরনে থাকত খুবই সাধারন একটা সাদা কাপড়, তারা বিছানায় শুতে পেত না মাটিতে শুতে হত । বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদেরও একাদশীর দিন একবিন্দু জলও খেতে দেওয়া হত না । কোনো সামাজিক কাজে তাদের যোগ দিতে দেওয়া হত না । অনেক সময় বিধবারা অসুস্থ হলে তাদের কোন ওষুধ পর্যন্ত দেওয়া হত না । আর তাদের এই অকাল বৈধব্যের জন্য তাদের বাবামাই দায়ী ছিল কারন বহু সময়েই বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের বয়েসে অনেক বড় বা বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দেওয়া হত । ফলে তাদের বৈধব্য অবশ্যম্ভাবী ছিল ।
মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো হতো না । কারন লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা নাকি বিধবা হয় এই ধারনা প্রচলিত ছিল । অথচ আমাদের মহাকাব্যে ও শাস্ত্রে কত শিক্ষিতা বিদুষী মেয়েদের কথা আছে ।
সধবা বাচ্চা মেয়েদেরও স্বামীর কাছে যৌন উৎপীড়নের শিকার হতে হত । পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে স্বামীর কাছে ধর্ষিতা হয়ে প্রান হারিয়েছে এরকম নজিরও আছে । বেশির ভাগ মেয়েরাই পনেরো বছরের মধ্যে দুটি থেকে তিনটি সন্তানের মা হয়ে যেত । শরীর অগঠিত হওয়ায় প্রচুর মেয়ের আঁতুরঘরে মৃত্যু ঘটত । তাতে অবশ্য কারোর কিছু এসে যেত না । সেই স্বামী বছর না ঘুরতেই আরেকটি বাচ্চা মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসত ।
কুলীন ব্রাহ্মনেরা শত শত বিয়ে করত । কোথায় কবে বিয়ে করেছে তা ভুলে যাবে বলে মোটা জাবদা খাতায় তা লিখে রাখত । মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে খালি টাকা নিয়ে আসত কিন্তু পরিবারের কোন দায়িত্ব নিত না । অনেক মেয়ে সারা জীবনে একবারও স্বামীর দর্শন পেত না । আর এই কুলীন ব্রাহ্মনের যখন মৃত্যু ঘটত তখন সমস্ত শ্বশুর বাড়িতে খবর দেওয়া একটা ঝকমারি ব্যাপার হত । একজনের মৃত্যুতেই আড়াইশো তিনশো মেয়ের জীবনে নেমে আসত চরম দুর্দিন । আবার অনেক সময় দুই তিন সতীন একই বাড়িতে বসবাস করত এবং স্বামীর অধিকার নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে মরত ।
অনেক সময় বাবা মা শপথ করত তারা তাদের প্রথম সন্তান কে গঙ্গাসাগরে বিসর্জন দেবে । নিজের বাবা মার হাতেই সেই অসহায় শিশুটির জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটত বিনা কারনে এবং বিনা দোষে ।
গ্রামের দরিদ্র কৃষকেরা দিন কাটাত চরম কষ্টে । কারন জমিদারের লোকেরা মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করত । বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানীতে আছে এই সমস্ত ঘটনার কিছু বিবরন । খাজনা দিতে না পারলে জমিদারের লোক কৃষককে বেঁধে রেখে চোখে পিঁপড়ে ছেড়ে দিত । নাভিতে পোকা ভরে বেঁধে রাখত । মেয়েদের স্তন কেটে নিত । এছাড়া পিটুনি গুমখুন তো ছিলই । জমিদারের আদেশে কৃষককে বেগার খাটতে হত জমিদারের বাড়িতে কোন প্রতিবাদ করা চলত না ।
ভাবুন তো আমরা যদি মাত্র দুশো বছর আগে এই পৃথিবীতে জন্মাতাম তাহলে আমাদের এইরকম পরিবেশে থাকতে হত । এখনও কেউ কেউ আছেন যাঁরা আমাদের অতীত নিয়ে গর্ব করেন । মনে দুই হাত দিয়ে তাদের কান টেনে ফাঁক করে চিৎকার করে এই অতীতের কাহিনী শোনাই যে কেমন গৌরবময় ছিল আমাদের অতীত ।
আজ আমাদের মধ্যে এই প্রথাগুলো না থাকলেও রয়ে গেছে তাদের কিছু ছায়া । যেমন বিভিন্ন রকমের সতীর মেলা বা মন্দির, বিধবাদের অম্বুবাচী, প্রভৃতি । আসুন এই শেষ স্মৃতি গুলিকেও আমরা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিই ।

2 comments:

Ragib Hasan said...

আপনার কথাটা সত্যি। আসলেই আগের কালে অনেক কুপ্রথা চালু ছিল।

তবে ব্যাপার কি জানেন ... সভ্যতার চরম শিখরে থাকা ইংল্যান্ডেও কিন্তু এসব কম ছিলনা। আমি ইদানিং আইন, বিচার, অপরাধ তত্ত্ব নিয়ে শখের বশে পড়াশোনা করছি, সেখানেই পড়লাম, ১৭২৫ সালেও ইংল্যান্ডে স্বামী হত্যার দায়ে এক মহিলাকে আধা গলা টিপে, জ্যান্ত অবস্থাতেই পুড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ১৮৩০ সালের আশে পাশে ইংল্যান্ডে কয়েক শ ভিন্ন ভিন্ন তুচ্ছ অপরাধেই ফাঁসী দেয়া হত। এক বছরে সেখানে ৯০০০ অপরাধী, যাদের অনেকেই শিশু, তাদের ফাঁসীতে ঝোলানো হয়। এদের মধ্যে ৯ বছরের একটি বালকও ছিল, যার অপরাধ শুধু জানালার কাঁচ ভেঙ্গে মোমবাতি/প্রদীপের তেল নেয়া।

আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলাই বাহুল্য। আমার দেখা একটা ডকুমেন্টারির কথা মনে পড়ছে, এক কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র দক্ষিণের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে, তাকে অন্য সাদা ছাত্ররা থুতু, কিল, চড় লাথি সমানে দিচ্ছে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময়।

জানিনা, "আজি হতে শতবর্ষ পরে", ভবিষ্যতের মানুষরাও আজকের একবিংশ শতাব্দীকে কেমন চোখে দেখবে। ইতিহাস আমার একটা প্রিয় বিষয়, তাতে পড়েছি সব সময়ই মানুষ বর্তমানের চেয়ে আগের কালকে খুব খারাপ বা খুব ভাল এমন চোখে দেখে। মাঝামাঝি খুবই কম হয়।

Arijit said...

http://news.bbc.co.uk/1/hi/world/south_asia/5273336.stm

আজ, এই ২০০৬ সালেও।