সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু কথা
আধুনিক বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কিছু লিখতে হলে কিছুতেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না । আমার ছোটবেলা থেকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখক । তার মানে এই নয় যে সুনীলের সব লেখাই আমার ভালো লেগেছে । রবীন্দ্রনাথ আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া আর কোনো বাংলা সাহিত্যিককে আমার মনে পড়ে না যিনি কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাসে সমান ভাবে সফল ।
আমরা কখনও কখনও কোনো লেখকের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলি যে অমুক লেখক অনেক বই লিখেছেন । কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হবে যে উনি অনেক আলমারি বই লিখেছেন । এটা আমার অদ্ভুত লাগে যে একজন লেখক কিভাবে এত লেখেন যে তা পড়ে শেষ করা যায় না ।
লেখক হিসাবে সুনীলের সাফল্যের কারন হল ওনার সহজ সরল ভাষা । এবং লেখার ভিতরে অহেতুক দর্শন আর নানা রকম তত্বের কচকচি না আনা । এই কারনে বইগুলো সহজ পাঠ্য । সুনীলের বহু কবিতা আর গল্পের চরিত্রের মধ্যে প্রচন্ড প্যাশান কাজ করে । সুনীলের সফলতা হল তাঁর বয়স বাড়লেও লেখার ভিতরে প্যাশন কমেনি ।
আমি সন্তু কাকাবাবু থেকে আরম্ভ করে নীললোহিতের এবং স্বনামে লেখা বহু বই পড়েছি । আমার সবথেকে পছন্দের বই হলো যেগুলো নীললোহিত ছদ্মনামে লেখা হয়েছে । চলো দিকশূন্যপুর বলে একটা বই পড়ে ভীষন ভালো লেগেছিল । তার পর থেকে নীললোহিতের বই পেলেই আগে পড়ি ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার স্টাইল যাদের পছন্দ তাদের সুনীলের বেশিরভাগ লেখাই ভালো লাগবে এটাই স্বাভাবিক । তবে সুনীলের বহু মাঝারি উপন্যাস যেগুলো পূজাবার্ষিকিতে বেরিয়েছিল অনেকগুলোরই মান যথাযথ নয় । খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা বলে বোধহয় ।
তবে সকলেই স্বীকার করবেন সুনীলের সেরা লেখা তাঁর কবিতা আর ছোটগল্পগুলো । বেশ কিছু কবিতা তো কিংবদন্তী হয়ে গেছে । আমার বেশ কিছু ছোটগল্প পড়েও খুবই ভালো লেগেছে ।
তবে সুনীলের লেখক জীবনের সব থেকে বেশী পরিশ্রম গেছে যে তিনটি উপন্যাসের পিছনে তা হল সেই সময়, প্রথম আলো আর পূর্ব পশ্চিম । তিনটিই আকারে বিরাট । এতবড় বিশাল পটভূমিকায় প্রচুর চরিত্র যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ঐতিহাসিক চরিত্র তাদের নিয়ে লেখা সোজা কথা নয় । একটু তথ্যের গন্ডগোল বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারত । কালীপ্রসন্ন সিংহের আদলে তিনি সেই সময় উপন্যাসে যে নবীনকুমার চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন তা করতে যথেষ্ট সাহসের দরকার লাগে । বিশেষ করে নবীন কুমারের বাবা যে আসলে জমিদার নয় তাদেরই নায়েব এরকম কল্পনা করে লেখা বিরাট বিতর্ক তৈরি করতে পারত । লেখার জন্য পরিশ্রম করেন এরকম খুব স্বল্প লেখকের মধ্যে সুনীল অন্যতম । এই তিনটি উপন্যাস লেখার জন্য তাঁকে প্রচুর গবেষনা করতে হয়েছে ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ধর্মে একেবারেই বিশ্বাস করেন না । তাঁর কোনো লেখাতেই কোনো রকম স্পিরিচুয়াল কিছু পাওয়া যায় না । শুধুমাত্র জাগতিক বিষয় নিয়েই তাঁর সমস্ত লেখা । তাঁর সমসাময়িক আরো দুই সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় কিন্তু আধ্যাত্মিক বিষয়ে অনেক লেখা লিখেছেন । সুনীলের সমস্ত লেখাই কেবলমাত্র জাগতিক বিষয় নিয়ে ।
যৌনতার ব্যাপারে সুনীলের মতামত খুব উদার । তাঁর বহু চরিত্রকেই প্রায়ই নানা রকম যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায় । যৌনতা বিষয়ে খোলাখুলিভাবে লিখতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই । যৌনতা যে আসলে কোনো বিকৃতি নয় কেবল মাত্র আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার একটা অঙ্গ তা তিনি বারে বারে লিখেছেন ।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উপন্যাস সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ লিখেছেন বলে আমার জানা নেই । তাও আবার দু দুটি । প্রথম আলোর পর সুনীল লেখেন রানু ও ভানু । রানু ও ভানুতে তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথ যখন রানুকে প্রথমবার দেখেন তখন নাকি সে পুরো নগ্ন অবস্থায় ছিল । অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের প্রতিষ্ঠাতা লেডি রানু এই কয়েক বছর আগেও জীবিত ছিলেন । তাঁকে নিয়ে এরকম লেখা কম সাহসের কাজ নয় । যদিও সুনীল দাবি করেছিলেন তিনি নাকি এই তথ্য লেডি রানুর আত্মজীবনী থেকে সংগ্রহ করেছেন । যাই হোক এসব সত্বেও সুনীলকে কখনও বড় বিতর্কের মুখে পড়তে হয় নি ।
লেখার উপকরন সংগ্রহ করার জন্য সুনীল অনেক ঘুরেছেন । পৃথিবীর বহু দেশে গেছেন । কিন্তু তিনি পশ্চিমবঙ্গেরও বহু স্থানে ঘুরেছেন । এই কারনে যখন তিনি কোনো জায়গার বর্ণনা দেন তা সে আমেরিকাই হোক বা মুর্শিদাবাদের কোনো অজ পাড়াগাঁই হোক তা পড়ে স্বাভাবিক মনে হয় । সন্তু কাকাবাবুর বেশিরভাগ অ্যাডভেঞ্চারই তো ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে ।
তবে তাঁর প্রিয় বন্ধুরাই তাঁর অনেক সমালোচনা করেছেন । আনন্দবাজারের মত বড় এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে তিনি আসলে নিজেই নিজের কথা রাখেননি তাও তাঁরা বলেছেন । বর্তমানে শাসক সিপিএমের সাথে তাঁর দহরম মহরমও অনেকেই ভাল চোখে দেখছেন না । আমরা সাধারনত কবি সাহিত্যিক দের একটু প্রতিবাদী চরিত্রেই দেখতে ভালোবাসি । সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সুনীলকে এখন কেবল সিপিএমের ধামাধরা বলেই মনে হয় ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কে একবার দেখেছিলাম কলকাতা বইমেলায় ইউবিআই অডিটোরিয়ামে স্টেজের উপর মুখ হাঁড়ি করে বসে আছেন । হাতদুটো জড়ো করে টেবিলের উপর রাখা । সেদিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম এই হাত দিয়েই ওই আলমারি আলমারি বই গুলো লেখা হয়েছে ! তবে আমার মনে হয় নীললোহিতের এইরকম সভায় সভাপতিত্ব করা কিছুতেই পোযাত না । মনে হয় বেশি বয়সে রবীন্দ্রনাথের মত সুনীলও গুরুদেবের মত কিছু একটা হয়ে উঠতে চাইছেন ।
তবুও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনেকেরই প্রিয় কারন তাঁর লেখক সত্ত্বা চিরযুবক । তিনি মূলত কিশোরদের লেখক । কিশোর বয়েসে যারা তাঁর লেখা পড়েছে তারা প্রায় সবাই যে তাঁর ফ্যান হয়ে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । ষোলো সতেরো বছর বয়েসে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর বেলায় সুনীলের কোনো প্রেমের উপন্যাস অনেকরই জীবনে ডেকে এনেছে এক নতুন স্বাদ । এই বয়সে প্রথম সিগারেট প্রথম প্রেম প্রথম চুমুর মত সুনীলের লেখাও হয়ে ওঠে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । এবং এখানেই সুনীলের সার্থকতা ।
No comments:
Post a Comment